বাঙালীর খাদ্য সংস্কৃতিকে ঘিরে বিখ্যাত প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালী’। বাঙালী মাছপ্রিয়। আমরা মিঠাপানির মাছ বেশি পছন্দ করলেও পুষ্টিগুণ বিচারে সামুদ্রিক মাছ কোন অংশেই কম নয়। মাছকে বলা হয়ে থাকে নিরাপদ প্রোটিনের উৎস। সামুদ্রিক মাছের আমিষ সহজে পরিপাক হয়। সামুদ্রিক মাছের তেল ওমেগা- ৩ ফ্যাটি এর একটি উৎস, যা ‘মস্তিস্কের খাদ্য’ নামে পরিচিত। সামুদ্রিক মাছে আছে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ লবণ। এছাড়াও মাছে চর্বি, খনিজ তেল, আয়রণ, ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস পাওয়া যায়। মাছের শতকরা ২৩ ভাগই আমিষ। মাছ, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। মাছ মানুষের হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ককে কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ৫৪৯,০০০ নারীর উপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে যে, যেসব নারী প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার মাছ খান তাদের তুলনায় মাছ না খাওয়া নারীরা ৫০ শতাংশ বেশি হার্ট এটাকের ঝুঁকিতে থাকেন। প্রতি সপ্তাহে মোটামুটি পরিমাণ মাছ খেলে হৃদরোগের কারণে মৃত্যুঝুকি ৩৬ শতাংশ কমে।
ছবিঃ সামুদ্রিক মাছ (উৎসঃbd24live.com)
সামুদ্রিক মাছের তেলে থাকা ওমেগা-৩ নামক অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড থাকে যা রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল LDL ও VLDL কমায় এবং উপকারী কোলেস্টেরল HDL বাড়িয়ে দেয়, ফলে হার্টের রক্তনালীতে চর্বি জমতে পারেনা এবং রক্তনালী পরিষ্কার, সুপরিসর থাকায় রক্ত চলাচল বাধাহীন থাকে। মাছ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমায় এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা হ্রাস করে। আমিষের উত্স হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ অতুলনীয়। চুলের গঠনের মূল উপাদান হলো প্রোটিন। চুলের গঠন সুন্দর এবং চুলপড়া প্রতিরোধে সামুদ্রিক মাছের প্রোটিন খুব কাজে দেয়। মাছের ওমেগো-৩ ত্বকের কোষের গঠনে ভুমিকা রাখে, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। তাছাড়া মাছের ফ্যাট ত্বকের মসৃণতা বাড়ায় আর পানি ও খাবারের পুষ্টি ত্বকের ভিতরে গিয়ে টক্সিন বের করে দেয়। এই ফ্যাট ভাজা মাছের থেকে বেক বা গ্রিল করা মাছে অনেক বেশি পাওয়া যায়। চোখের দৃষ্টি ভালো রাখতেও সাহায্য করে সামুদ্রিক মাছ। এটি বাচ্চাদের মস্তিষ্কের গঠন উন্নত করে ও স্মৃতি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া, মাছের তেলে থাকা ডকসা হেক্সোনিক অ্যাসিড এবং এলকোসা পেন্টাএনোইক অ্যাসিড মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়।
আমাদের ত্বকে উৎপন্ন ভিটামিন ডি এবং সামুদ্রিক মাছ থেকে পাওয়া ওমেগা-৩ একত্রে মিলে মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই সেরোটোনিনই দেহের কর্মকাণ্ড এবং মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। নিয়মিত মাছ খেলে কিডনি ভালো থাকে। টাটকা মাছ খেলে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। মাছ ভিটামিন-বি এর উৎকৃষ্ট উৎস। বিশেষ করে স্যামন মাছে প্রচুর ভিটামিন বি-১২ রয়েছে। মাছে জিংক ও আয়োডিন আছে। জিংক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আয়োডিন গলগণ্ড রোগ প্রতিরোধ করে। সামুদ্রিক মাছে প্রচুর সিলেনিয়াম রয়েছে, যা দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। স্যামন, ম্যাকরেল মাছ থেকে ভিটামিন-এ ও ডি পাওয়া যায়। এই মাছের আমিষ ও তেল দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস রোগীরা খাদ্য তালিকায় সামুদ্রিক মাছ রাখা যায়। যেসব নারী তাদের গর্ভকালীন সপ্তাহে অন্তত ৩৪০ গ্রাম সামুদ্রিক খাবার খান তাদের সন্তান বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। যারা সপ্তাহে একাধিকবার সামুদ্রিক মাছ খান তাদের বুদ্ধি যারা সচরাচর সামুদ্রিক খাবার খান না তাদের চেয়ে ১১ গুণ বেশি। এ ছাড়া যারা মাছ বেশি খান তাদের শেষ বয়সে ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা অনেকাংশে কমে যায়।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সামুদ্রিক খাবার খান (সরাসরি খাদ্য হিসেবে কিংবা পরিপূরক হিসেবে) তাদের শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি বিসাদ্গ্রস্ততা বা মনমরা ভাব দূরীভূত হয়। এর কারণ হচ্ছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের দু’টি প্রধান রাসায়নিক উপাদান সেরোটোনিন ও ডুপামাইনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ দু’টি উপাদানের মাত্রা বা পরিমাণ কম থাকলেই মানসিক বিষাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব সৃষ্টি হয়।
উপরের আলোচনা থেকে এখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সামুদ্রিক মাছ মানুষকে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ রাখে। দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সপ্তাহে অন্তত দুই দিন নিয়ম করে মাছ খাওয়া উচিত।
লেখকঃ আরিফুজ্জামান সজীব
তথ্যসূত্র: ১।https://authoritynutrition.com/11-health-benefits-of-fish/
২। http://www.heart.org